মেট্রোরেলে ৪৫ ত্রুটি: বৃষ্টির পানি, এসি বিকলসহ নানা সমস্যা

মেট্রোরেলে ৪৫ ত্রুটি: বৃষ্টি ঢোকে, এসি বিকল, যন্ত্রে টিকিটে ঝামেলা

ঢাকার মেট্রোরেলে যাত্রীর টিকিট পরীক্ষা হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে—প্রবেশ বা প্রস্থানকালে টিকিট ছোঁয়ানো বা জমা দিতে হয় নির্দিষ্ট গেটে। পরিকল্পনা ছিল, প্রতি এক লাখ যাত্রীর মধ্যে মাত্র একজন প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হবেন। কিন্তু বাস্তবে প্রতি এক লাখ যাত্রীর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার জনের ক্ষেত্রে যন্ত্রটি ঠিকভাবে কাজ করছে না।

মেট্রোরেলে ৪৫ ত্রুটি: বৃষ্টির পানি, এসি বিকলসহ নানা সমস্যা


রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ৪৫ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি শনাক্ত করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ করেনি বা মান বজায় রাখেনি।

ডিএমটিসিএলের সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় ১০ ধরনের ত্রুটি, বৈদ্যুতিক কাজে ১৬টি, অবকাঠামোগত (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) অংশে ১০টি, আর ট্রেন ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশে ৯ ধরনের সমস্যা পাওয়া গেছে।
এসব নিয়ে ৬৩ পৃষ্ঠার বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করে ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আংশিক মেরামত হলেও স্থায়ী সমাধান হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী মানসম্পন্ন উপকরণও ব্যবহার করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুর্ঘটনা ও ত্রুটির আশঙ্কা

২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেল স্থাপনার একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী আবুল কালামের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেও একই স্থানে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ত্রুটি বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি না বাড়ালেও চলাচলে বিঘ্ন ও ঘন ঘন মেরামতের প্রয়োজন তৈরি করছে। চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল ৩০ থেকে ৪০ বার বন্ধ রাখতে হয়েছে, যা কখনো ২০ মিনিট, কখনো ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে।

ঠিকাদারের দায় ও নতুন দাবি

চুক্তি অনুসারে নির্মাণকাজ শেষের পর দেড় বছর পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ত্রুটি মেরামতের দায়িত্ব নিতে হয়। সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও, ডিএমটিসিএল চাইছে আরও দুই বছর বিনা খরচে এই মেরামত অব্যাহত রাখতে। এ বিষয়ে ঠিকাদার ও পরামর্শককে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ডিএমটিসিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ, যিনি বিদেশে একাধিক মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, বলেন—
“দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমি ত্রুটি ও ঘাটতির বিষয়গুলো সমাধানে পরামর্শককে চিঠি দিচ্ছি, কিন্তু সন্তোষজনক ফল পাচ্ছি না। পুরো প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।”

ব্যয় বেড়েছে, মান কম

২০১২ সালে নেওয়া মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) দিয়েছে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার ঋণ।
প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা—এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বহু গুণ বেশি, বিশ্বেও শীর্ষে। তারপরও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয় আটটি অংশে (প্যাকেজে)। নকশা, তদারকি ও ঠিকাদার নিয়োগের দায়িত্বে ছিল এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন, যার নেতৃত্বে রয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই। এ জোটে আরও আছে দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন, মট ম্যাকডোনাল্ড, এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস (ডিডিসি)।
২০১৩ সালে প্রায় ১,০৬৩ কোটি টাকার বিনিময়ে এই পরামর্শক দলকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল কাজের মান যাচাই ও ঠিকাদারের কাজ নিশ্চিত করা। ডিএমটিসিএল তাই মূলত পরামর্শককেই জবাবদিহিতার আওতায় আনছে।

এনকেডিএমের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত দলনেতা হিসেবে আছেন জাপানের তাকাউকি ফুজিতোমি। ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তাঁর কাছে ইমেইলে প্রশ্ন পাঠানো হলেও এখনো কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় চুরির সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال