পদ্মার চরে দাপট ‘কাকন বাহিনীর’, কথার আগে চলে গুলি

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়ায় পদ্মা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলছিলেন ইজারাদার সুলতান আলী বিশ্বাসের কর্মীরা। হঠাৎ কুষ্টিয়া প্রান্ত থেকে স্পিডবোট ও বড় নৌকায় করে মুখোশধারী একদল সশস্ত্র ব্যক্তি গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসে। আতঙ্কে শ্রমিকরা দৌড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও নদীপারের বেশ কয়েকটি বাড়ির টিনের বেড়া ও চাল গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

পদ্মার চরে দাপট ‘কাকন বাহিনীর’, কথার আগে চলে গুলি

১৩ অক্টোবরের এই ঘটনাটি নিয়ে স্থানীয়দের দাবি—বালুমহালের ইজারাকে কেন্দ্র করে ‘কাকন বাহিনী’ নামের সশস্ত্র একটি দল এমন হামলা চালায়। বালু দখল, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, জমি জবরদখলসহ নানা অপরাধে বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের লালপুর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এখন এই বাহিনীর ত্রাস বিরাজ করছে।

সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর দৌলতপুরের পদ্মা নদীর দুর্গম চরে কাকন বাহিনীর গুলিতে দুই কৃষক নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত আরও দুজন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহতরা হলেন মণ্ডল গ্রুপের আমান মণ্ডল (৩৬) ও নাজমুল মণ্ডল (২৬)। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কাকন বাহিনীর সদস্য লিটন (৩০) নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

স্থানীয়রা জানায়, প্রধানের নাম অনুসারে এ বাহিনীর নাম ‘কাকন বাহিনী’। পদ্মা নদীতে স্পিডবোট নিয়ে তারা নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া দেয়। সম্প্রতি ড্রোনে ধারণ করা তাদের কার্যক্রমের ভিডিও প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এরপরও বাহিনীর দাপট কমেনি। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, চাঁদা না দিলে তারা ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। কাশবন দখলকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রতিক গোলাগুলির সূত্রপাত ঘটে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, “আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আপনারা দেখবেন, পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়।”

দুইজনকে হত্যার ঘটনায় কাকনকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মার দুর্গম চরে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয়, যারা বালু ও জমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। অপরাধের পর তারা অন্য চরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। কখনো বিশাল কলাবাগান বা সীমান্তের শূন্যরেখার মাঠে তাদের আস্তানা গড়ে ওঠে।

প্রায় ২০ বছর আগে এই চরাঞ্চলে ‘পান্না বাহিনী’ ও ‘লালচাঁন বাহিনী’ নামে দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দাপট ছিল। তাদের দ্বন্দ্বে ৪১ জন নিহত হয়েছিলেন। তখন চরাঞ্চলে আতঙ্কে কেউ পা দিতে সাহস পেতেন না। ওই সময় পান্না বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান ‘কাকন বাহিনীর’ কাকন। ২০০৫ সালে ‘ক্রসফায়ারে’ পান্না নিহত হওয়ার পর শান্তি ফিরে এলেও কাকনের নেতৃত্বে নতুন করে সন্ত্রাসের মুখে পড়েছে পদ্মার চর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ‘কাকন বাহিনী’র বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়েছে—এর মধ্যে ঈশ্বরদী থানায় তিনটি, বাঘা, লালপুর ও দৌলতপুর থানায় একটি করে। এসব মামলার মধ্যে ঈশ্বরদীর দুটি ও বাঘার একটি মামলা নৌ পুলিশ তদন্ত করছে। এখনো কোনো মামলার তদন্ত শেষ হয়নি।

একটি মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, কাকনের পুরো নাম মো. রোকনুজ্জামান কাকন ওরফে ইঞ্জিনিয়ার কাকন। তার বর্তমান ঠিকানা পাবনার ঈশ্বরদী কলেজ রোডে, তবে পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের মাজদিয়াড় গ্রামে। ২০০১ সালে একটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের পর তিনি পরিবারসহ দৌলতপুর থেকে ঈশ্বরদীতে চলে আসেন। ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি নেওয়ায় নামের আগে যুক্ত হয় “ইঞ্জিনিয়ার”।

আরও পড়ুন: ভাসাবে নাকি ডোবাবে আজ বাংলাদেশ?

Post a Comment

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال